২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মৃত নগরী ঢাকা

-

কোনো শহরে যানবাহনের গতি ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারের নিচে নেমে এলে সেটিকে মৃত নগরী হিসেবে ধরে নেয়া যায়। এ হিসাবে ঢাকা শহর মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন উঠে এসেছে। কারণ এক দশক আগেও রাজধানী ঢাকায় যানবাহনের ঘণ্টায় গড় গতি ছিল ২১ কিলোমিটার। বর্তমানে তা সাত কিলোমিটারে নেমে এসেছে। সড়কে যানজটের কারণে প্রতিদিন রাজধানীবাসীর ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। গত বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংক আয়োজিত এ নিউ আরবান ডেভেলপমেন্ট প্যারাডাইম, ইস্ট ওয়ার্ড শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব তথ্য উঠে আসে।
অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে ঢাকার নগরায়ণবিষয়ক একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, রাজধানীর যানজটের চিত্র এতই ভয়াবহ যে উত্তরা বা মিরপুর থেকে সকালে রওনা দিয়ে মতিঝিল গিয়ে কাজ সেরে ঘরে ফেরা যে কারোর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যানজটে প্রতিদিন নগরবাসীর ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ফলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এই ৩২ লাখ কর্মঘণ্টায় আরো চার লাখ লোকের সমান কাজ পাওয়া যেত। যানজট সমস্যার সমাধান সম্ভব হলে রাজধানীসহ দেশের অর্থনীতিতে আরো ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারত। সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নও অনেক সহজ হয়ে যেত। পাশাপাশি বাংলাদেশ যে জুতসই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তা বাস্তবায়নও অনেকটাই সহজ হয়ে যেত।
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন (এলজিআরডি) ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, পিপিআরসির চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্টিন রামা, অপফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যান্থনি ভেনাবল, স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রমুখ।
বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ঢাকায় প্রতিবছরই বসতি বাড়ছে। ১৯৮০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল তিন মিলিয়ন বা ৩০ লাখ। বর্তমানে জনসংখ্যা বেড়ে এক কোটি ৮০ লাখে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ লাখ মানুষ বস্তিতে বাস করে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সালে ঢাকার লোকসংখ্যা হবে আড়াই কোটি। রাজধানীতে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে যানবাহনের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে। গত ১০ বছরে যানবাহন চলাচলের গড় গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে সাত কিলোমিটারে নেমে এসেছে। অথচ মানুষের হেঁটে চলার গড় গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার।
বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে যানজট সমস্যার সমাধান ও নতুন কর্মসংস্থানের জন্য কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়। বিশ্বব্যাংক সে লক্ষ্যেই কাজ করছে বলে জানানো হয়। এ জন্য কিছু পদক্ষেপ নিলে ঢাকায় অতিরিক্ত আরো ৫০ লাখ মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা যাবে। একই সাথে ১৮ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এ জন্য বন্যার হাত থেকে বাঁচতে ও পানির গতি ঘোরাতে বালু নদীর তীরে একটি বাঁধ দেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি ঢাকার পূর্বাঞ্চলের আধুনিকায়নের মাধ্যমে একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে তুলে মূল ঢাকার সাথে পরিবহন যোগাযোগ সহজতর করা প্রয়োজন। গণপরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা গেলে শহরের পরিধিও বাড়বে, পাশাপাশি সেখানে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। রাজধানীর যানজটও অনেক কমে আসবে। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে পারলে ২০৩৫ সালের মধ্যে বছরে পাঁচ হাজার ৩০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক কার্যক্রম যুক্ত হবে। এতে রাজধানীবাসীর আয়, এমনকি মাথাপিছু আয়ও অনেক বাড়বে।
মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিভিন্ন কারণে বৈশ্বিক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম মেগাসিটি হিসেবে ঢাকাকে আধুনিক ও টেকসই নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা মহানগরীর যানজট ও জলাবদ্ধতা দূর করতে সরকার কাজ করছে। নগরীতে বিশুদ্ধ পানীয়জল সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন নিশ্চিত করতে ঢাকা ওয়াসা দুটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়া নতুন ওয়ার্ডগুলো যাতে সমানভাবে উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করে, সে লক্ষ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব ওয়ার্ডের উন্নয়নকাজও হচ্ছে পরিকল্পনামাফিক। সরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য নগরী গড়তে বদ্ধপরিকর। পরিবেশদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে টেকসই নগরী গড়ে তুলতে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলো কাজ করছে। ঢাকার চার পাশের নদীগুলোর দূষণ রোধ ও নাব্য রক্ষায় একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে সরকার কাজ করছে।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকা শহর বসবাসের যোগ্য কি না, সে প্রশ্ন এখন সবার। ঢাকা শহর মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে কিনা, সে প্রশ্নও উঠছে। কিন্তু শহরকে সুন্দরভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যা করা প্রয়োজন, সেখানে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement